শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১১ অপরাহ্ন
মাওলানা ইয়াছিন হাবিব:
দেশে করোনা নামক ভাইরাস আতংক প্রকট আকার ধারণ করে চলছে। ভুক্তভোগি ব্যাক্তি, পরিবার চরম সংকটে দিনাতিপাত করছে। ডাক্তার, নার্স, জনপ্রতিনিধিসহ সকল নাগরিক উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় কখন কে আক্রান্ত হয়!
দিনদিন দেশের স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার চরম অব্যাবস্থাপনা, অক্ষমতা, ব্যর্থতা জনগণের সামনে পরিস্কার হচ্ছে। বলার কেউ নেই। দেখার কেউ নেই। আক্রান্ত ব্যক্তিরা রোগ নিরাময়ের জন্য যেখানেই যায় সেখানের দায়িত্বরত কর্তারা পারত পক্ষে রোগির ধারে কাছেও যেতে চায় না। পারলে দায়িত্ব এড়ানোর জন্য কৌশলে রোগির সক্ষমতা বিবেচনা না করে ভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। সব জায়গায় এড়িয়ে চলার মহান নীতি অনুসরণ করছে। গত সাপ্তাহের শুরুর দিকে আমার শাশুড়ী বেশী অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই। কর্তব্যরত ডাক্তার ভর্তিই নিতে চাইল না। জরুরী বিভাগের যৎসামান্য চিকিৎসা দিয়ে বিদায় করে দিল। ভর্তির জন্য একটু অনুরুধ করলাম। কার কথা কে শুনে? বেশী কাকুতি মিনতি করলে বলে- এটা করোনা রোগি না, এখানে থাকলে রিক্স হবে।
উপায়ান্তর না দেখে নিয়ে গেলাম সদ্য প্রতিষ্টিত ইউনিয়ন হাসপাতালে। ভর্তি করে কেবিনে নিলাম। দুদিন পর্যন্ত কেবিন ভাড়া দিয়ে কোন ডাক্তার রোগি দেখার জন্য আসল না। দু’একজন মহিলা নার্স এসে বিভিন্ন টেষ্ট নিয়ে গেল। কোন ট্রিটমেন্ট দিল না।
এ দিকে রোগির অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। চিকিৎসার কথা বললে বলে রিপোর্টে আসুক, অপেক্ষা করুন। সময়মত ডাক্তার আসবে।
একদিন পর বুঝলাম- করোনার ভয়ে হাসপাতালে রোগি দেখতে আসছে না ডাক্তার। তারপর সিদ্ধান্ত পাল্টালাম। ইউনিয়ন থেকে নিয়ে আসলাম আল ফুয়াদে। ভর্তি করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে দুই তিন দিন চিকিৎসা করালাম। রোগির তেমন কোন উন্নতি হল না।
পরিশেষে তারাও বলল রোগিকে বাড়িতে নিয়ে যান। চিকিৎসা যা দিয়েছি তা সেবন করতে থাকুন, ভাল হয়ে যাবে।
আমরা বললাম, এই রকম মুমূর্ষ রোগি নিয়ে বাড়িতে গেলে কি হবে? তারাও করোনার রোগের ভয় দেখাল। কোন উপায়ান্তর না দেখে রোগিকে আমার পাহাড়তলী বাসায় নিয়ে আসলাম। দু’দিন পর গত রোববার রোগির শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকল। শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। প্রেসার মারাত্মকভাবে উঠানামা করছে।
আমরা পরিবারের সকলে তাঁর পাশে বসে মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছিলাম। হায়রে তকদির! কারো কাছে ভরসা পাচ্ছিলাম না। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে অক্সিজেন সাপোর্টের জন্য নেবুলাইজার মেশিন ও অক্সিজেন সিলিন্ডার খুঁজতে পাগলের মত ছুটতে থাকলাম। কোথাও পেলাম না। আবশেষে আমার ফুফাত ভাই ডাক্তার সাজ্জাদ কাশেমকে বললাম। তিনি কাল বিলম্ব না করে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার যোগাড় করে দিলেন। তখন আমার মনে হয়েছিল আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি।
দ্রুত অক্সিজেন সাপোর্টের ব্যবস্থা করে মা-কে বাঁচানোর আশার আলো দেখতে পেলাম। মাহান আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করলাম। কিন্তু বিধিরবিধান কে জানে হাঠাৎ প্রেসার উঠানামা শুরু হল! এক পর্যায়ে আমরা পরিবারের সকলের সামনে কলিমায়ে শাহাদত পড়তে পড়তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য মহান রবের ডাকে সাড়া দিলেন। ইন্নালিল্লাহি ওইন্নাইলাইহি রাজিউন।
আমরা হারালাম মা-কে। মা যে এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন কল্পনাও করিনি। তার আদর ভালবাসা কি করে ভুলি? আমার জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে ছায়ার মত ছিলেন। আমার ছেলে মেয়েরা তাদের নানিকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গেছে। আমার সহধর্মীনি তাঁর প্রথম সন্তান। সে ছিল মা পাগল। কি বলে তাকে সান্তনা দেব, ভেবে পাচ্ছি না।
আমার স্নেহের শ্যালক খালেদ, বুখারী, হিফজু, হাফিজু, আতাউ, মর্জিয়া, মায়মুনাদের বুবা কান্না আমার সহ্য করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। সারাদিন মরহুমা মায়ের জন্যে কোরআন খতম করে তাহালিল পড়ে সময় পার করছে। আমার মুহতারমা শাশুড়ি আম্মা দ্বীনদার পরহেজগার মহিলা ছিলেন। তাঁর জন্ম ছিল খরুলিয়া দরগাহ পাড়ার বুজুর্গ ব্যক্তি মরহুম মৌলভী মাষ্টার শফি ছাহেবের পরিবারে। তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক ও হয়েছিল জোয়ারিনালার সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবার মাওলানা খলিলুর রহমানের ভ্রাতিস্পুত্র মাওলানা ক্বারী ফিরদাউস (রাঃ) এর সাথে। আলহামদুলিল্লাহ তাঁর ঔরসজাত সন্তানরা সকলে হাফেজ ও আলেম। তাঁর নাতিদের মধ্যেও ৩ জন হাফেজ। তার সারাজীবন কেটেছে দ্বীনি শিক্ষা থেকে বন্সিত বয়স্ক মহিলাদের মাঝে দাওয়াতের মেহনতে। প্রয়োজনীয় মাসআলা মসায়েল, নামাজের সুরা কেরাত শিক্ষা দেওয়ার কাজে। আমার জীবনে তাঁকে যতটুকু দেখেছি, তিনি একজন আল্লাহ ওয়ালা মহিয়সি নারী।
মহান আল্লাহ তার নেক আমলসমূহ কবুল করে জান্নাতের উ্চু মকাম দান করুন, আমিন।
পরিশেষে আমি পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর মাগফিরাতের জন্য সকলের কাছে দোয়ার দরখাস্ত করছি।
মাওলানা ইয়াছিন হাবিব