রবিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১:২৫ অপরাহ্ন
আরফাতুল মজিদ:
“রোজিনা আন্টির ওখানে গিয়ে সমিতি পাড়ার গলির ভিতরে জিনিস (ইয়াবা) গুলো দিবা, ওনি আমাকে পথ দেখায় দেয়, হা ওটা ওনার বোনের বাড়ি, তোমার বোনকে কি পাঠিয়েছিলে ওনার সাথে, আমার বোনকে একা পাঠিয়েছিল, কারণ ওনি একা ভয় পাচ্ছে তাই সমিতি পাড়া রানী ফামের্সীর ওখানে যায়, অ হ্যালো আপা ওখানে জিনিস (ইয়াবা) ৩০০ পাচ্ছি না তাই তোমার বোন এবং মিনাবি কে সামনে সামনি করতে হবে আমার, আর তোমাকেও সামনে করতে হবে, ওখানে তোমরা বলতেছো ১ হাজার জিনিস (ইয়াবা), ১ হাজার ওনি নিজেই হাত দিয়ে গুনে এবং বুজে নিয়েছে, এটাও সামনে সামনি করতে হবে। আচ্ছা আপা তুমি রাতে বাসায় আসো কথা হবে।” দুইজনের কথোপকথনের এমন একটি অডিও রেকর্ড এখন ভাইরাল। তারা দুইজন হলেন, কক্সবাজার ১নং ওয়ার্ড কুতুবদিয়া পাড়া এলাকার রোজিনা আক্তার ও নুর বেগম। তাদের দুজনের কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড ভাইরাল কয়েকদিন ধরে।
আরেকটি অডিও রেকর্ডে রোজিনা বলেন, “আমাকে ধরতে হলে আগে আমার পিছনে ১০০ জনকে ধরতে হবে, আমি যেমন তারাও তেমন, সবার আগে গডফাদার ধরতে হবে, আমিত চামিচ (ছোট)।” মাছন নামের একব্যক্তির সাথে রোজিনা আক্তারের এমন কথোপকথনও এখন ভাইরাল হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে রোজিনা আক্তারের বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকার জনশ্রুতি থাকলেও কয়েকদিন ধরে ফের আলোচনায় আসে রোজিনা। গত সোমবার বিকালে রোজিনা আক্তারের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তিন লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় কক্সবাজার সদর থানার তিন পুলিশ সদস্য। তাদের বরখাস্তও করা হয়েছে। বর্তমানে এই তিন সদস্যের রিমান্ডও চলছে। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটিও। কক্সবাজার শহরের ১নং ওয়ার্ড কুতুবদিয়া পাড়া এলাকায় রোজিনার বাড়িতে এই ঘটনা ঘটে। রোজিনা ওই এলাকার রিয়াজ আহমেদ ওরফে ইলিয়াছের স্ত্রী এবং মৃত নুর কবিরের মেয়ে।
কে এই রোজিনা :
২০১৮ সালের অক্টোবরের শুরুতে রোজিনা আক্তারকে চিহ্নিত ইয়াবা ও পতিতা ব্যবসায়ী উল্লেখ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কক্সবাজার সদর মডেল থানায় আবেদন করা হয়েছিল পূর্ব কুতুবদিয়া পাড়া সমাজ উন্নয়ন কমিটির প্যাডে। ওই আবেদনে বলা হয়েছিল, দীর্ঘদিন ধরে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত রয়েছে রোজিনা। এসব বন্ধ করতে অনেক বার বলা হলেও কারো কথা কর্ণপাত করেনা। বিভিন্ন জায়গা থেকে অসহায় মেয়ে এনে হোটেলে সরবরাহসহ নিজ কলোনীতে রেখে পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত করা হয়। তার কলোনীতে সন্ধ্যা হলে বসে ইয়াবা ও পতিতার হাট। এমনকি তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে কৌশলে ওই ব্যক্তির দোকান বা ঘরে ইয়াবা দিয়ে কৌশলে পুলিশকে খবর দিয়ে হয়রাণি করার অভিযোগ তোলা হয় আবেদনে। থানায় করা আবেদনে অনেক এলাকারবাসীর স্বাক্ষরও রয়েছে।
এই রোজিনাকে ইয়াবা ব্যবসায়ের গডফাদার উল্লেখ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর কক্সবাজার র্যাব ক্যাম্পে লিখিত আবেদন করেছিল একব্যক্তি। আবেদনে কক্সবাজার শহরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী শাহজাহান আনসারীর সাথে রোজিনার গভীর সখ্যতার কথা উল্লেখ রয়েছে (বর্তমানে শাহজাহান আনসারী আত্মসমর্পণ করে কারাগারে)।
এছাড়া ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি রোজিনা আক্তারের অত্যচারে অতিষ্ঠ হয়ে কক্সবাজার সদর থানায় সাধারণ ডায়েরী করেন মো. হোসেন নামে এক ভুক্তভোগি। রোজিনার নিয়মিত হয়রাণি ও ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর ভয়ে একই সালের ১২ জানুয়ারি মো. আবছার মিয়া নামে আরেক ভুক্তভোগি থানায় ডায়েরী করেন। ডায়েরীতে রোজিনাকে একজন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারী ও ডাকু মহিলা বলেও উল্লেখ করেন।
২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আয়েরা বেগম নামে এক মহিলা সদর থানায় এজাহার দায়ের করেন রোজিনার বিরুদ্ধে। এজাহারে রোজিনার মাদক কারবারিসহ সব অপকর্মের কাহিনী উল্লেখ করেন।
এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবরে অবৈধভাবে উপার্জিত ইয়াবা ব্যবসায়ীর সহায় সম্পদ ও ব্যাংক ব্যালেন্স তদন্তপূর্বক জব্দ করার আবেদন করা হয় রোজিনার বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর ডাকযোগে একব্যক্তি এই আবেদন করেন। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, রোজিনা আক্তার একজন গডফাদার এবং ইয়াবা স¤্রাজ্ঞী। তার স্বামী ইলিয়াস একজন বেকার। ইয়াবা ব্যবসা ও পাচার তাদের একমাত্র পেশা। রোজিনা ইয়াবা কারবারের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছে গত চারবছরে। ইতিমধ্যে শহরের বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় ৩৯ লাখ টাকা দিয়ে জমিও কিনেছে। সমবায় সুপার মার্কেটসহ বিভিন্ন জায়গায় তার বেশ কয়েকটি দোকানও রয়েছে। কক্সবাজার ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে বিশাল অর্থ। তার রয়েছে বিশাল রোহিঙ্গা নারী মাদক পাচারকারী সিন্ডিকেট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোজিনার বিষয়ে এলাকায় কেউ ভয়ে মুখ খুলে না। কিন্তু সবার মুখে মুখে রোজিনা একজন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি। তার বিরুদ্ধে মাদকের কোনো মামলা না থাকলেও বেশ কয়েকটি মাদকের অভিযোগ রয়েছে। তবে মারামারি মামলা রয়েছে তিনটি মতো। যার মামলা নং কক্সবাজার সদর থানার এফ আই আর নং-২৯/১৪৯, তাং ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ইং এবং মামলা নং-৫৯, তাং ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ইং। অপরটির মামলা নং ৭০, তাং ১ জানুয়ারি ২০১৪ ইং। এরমধ্যে দুইটি মামলায় দুইবার কারাগারেও যান সে। প্রায় দেড় বছর আগে কারাগার থেকে বের হয় রোজিনা। ওই সময় তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে শহরজুড়ে শোডাউনও করা হয়। তবে এলাকার জনপ্রতিনিধি বা সমাজের দায়িত্বশীল কেউ নয় রোজিনা। কিন্তু এলাকার সবাই ভয় পায় তাকে। তার পিছনে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তার অবৈধ কর্মকান্ডের বিষয়ে কেউ কথা বললে; হয়ত এলাকা ছাড়তে হয়, নাহয় বিভিন্ন ধরণের হয়রাণির শিকার হতে হয়। অথবা প্রভাবশালীরা হুমকি ও চাপ প্রয়োগ করে। এভাবে এলাকায় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রোজিনা। তার নির্যাতন ও হয়রাণির শিকার হয়ে অনেক নারী-পুরুষ এলাকা ছেড়েছে। কারাগারে যান বহুজন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে- রোজিনার ইয়াবা বিক্রি ও পাচার চক্রে রয়েছে ১০ থেকে ১২ জন নারী সদস্য। যারমধ্যে অধিকাংশ রোহিঙ্গা নারী। অনেকেই তার কলোনীতে অবস্থান করে ইয়াবা পাচার করে যাচ্ছে। এরমধ্যে রোহিঙ্গা নারী রয়েছে- হুমায়রা, লায়লা, নুর বেগম, নেছারু, তাহেরা ও লালানী। অন্যরা হলেন র্ঝণা, রোকসানা, নুর বেগম (২), রিপা ও রেজিয়া। ইতিমধ্যে রোজিনার ইয়াবা পাচারকালে আটক হয়েছিল হুমায়রা ও রোকসান। এসব নারীদের মাধ্যমে ইয়াবা বিক্রি ও পাচারে জড়িত বলে এলাকায় ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে। এমনকি রোজিনার সাথে নুর বেগমের ইয়াবা বিক্রির কথোপকথন ভাইরাল হয়। একই সাথে ভাইরাল হয় রোজিনার পিছনে ১০০ গডফাদার থাকার কথাও। রোজিনার স্বামী ইলিয়াস একটি গ্যাসের দোকানে বসে এসব নিয়ন্ত্রণ করে জানা গেছে। ইলিয়াসের ছোট ভাই সাদ্দামও ইয়াবাসহ দুইবার আটক হয়েছিল। একবার কক্সবাজার এসএ পরিবহণে অন্যবার চট্টগ্রামে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোনে রোজিনা আক্তার বলেন, ভাইরে ভাই আমার বিরুদ্ধে নিউজ করিয়েন না। আমি কোন মাদকে জড়িত নয়। আমি জমি ও যা দোকান কিনেছি তা মাদকের টাকা নয়। অন্য কিছুর টাকা দিয়ে কিনেছি। এসব মোবাইলে বলতে পারছি না।
অডিও রেকর্ড ভাইরালের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি এলাকার বিভিন্ন বিচার করি। একটি বিচার নিয়ে এক মহিলার সাথে মোবাইলে কথা হয়। যা রেকর্ড শুনেছেন তা ইয়াবার বিষয় নয়। বিচারের বিষয় ছিল। গডফাদারের বিষয়ে রোজিনা বলেন, আমার এলাকার মাছন নামে একব্যক্তির সাথে আমার পরিচয়। তার সাথে মোবাইলে কথা বলার সময় দুষ্টামির ফাঁকে গডফাদারের কথা বলা হয়েছে। সে আমার সাথে দুষ্টামি করে কৌশলে রেকর্ড নিয়েছে।
কক্সবাজার পৌরসভার প্যানেল মেয়র এবং ১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের মহিলা কাউন্সিলর শাহেনা আক্তার পাখি বলেন, রোজিনা আক্তার আমার নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা। তবে মাদক কারবারি কিনা আমি দেখিনি। কিন্তু বিভিন্ন জনের কাছ থেকে শুনেছি রোজিনা ইয়াবা বিক্রি করে এবং লোকজন দিয়ে ইয়াবা ছিনতাইও করে থাকে। রোজিনার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অনেকেই আমার কাছে করেছিল।
জানতে চাইলে কক্সবাজার সদর থানার ওসি অপারেশন মো. সেলিম বলেন, আমি রোজিনা সম্পর্কে কিছুই জানি না। ওনার সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে রাজি নয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক সোমেন মন্ডল বলেন, কুতুবদিয়া পাড়া এলাকার রোজিনা আক্তারের বিষয়ে আপাততে কিছু বলতে পারছি না। যদি আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়ে থাকি তাহলে অভিযান চালিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিবো। তালিকাভুক্ত নয় বা মামলা নেই এমন অনেকেই রয়েছে কক্সবাজারে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। যখন হাতেনাতে আটক করতে পারি, তখন বলা যায় আসলে মাদক কারবারি কে। মামলা নেই এমন অনেকজন মহিলাকে আমরা অভিযান চালিয়ে সমিতি পাড়া ও কুতুবদিয়া পাড়া থেকে ইয়াবা ও গাঁজাসহ আটক করেছি ইতিমধ্যে। আমাদের নিয়মিত অভিযানও চলে ১নং ওয়ার্ডে। ঘনবসতি এলাকা হওয়ায় ওখানে অনেক খুচরা মাদক কারবারি রয়েছে বলে তিনি জানান।