বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম :
ঈদগাঁও ইউনিয়ন বিএনপি’র আহবায়ক কমিটি স্বেচ্ছাসেবক দল ফতেখারকুল শাখার ৭ সদস্যের কমিটি অনুমোদন কক্সবাজার জেলা জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক এড. মোহাম্মদ তারেক জামিনে বেরিয়ে এসে মালুমঘাটে হত্যা মামলার আসামীদের হামলা লুটপাট কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি পরিদর্শনে চট্টগ্রামের সমন্বয়ক টিম বন্যাদূর্গত পরিবারে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আর্থিক সহায়তা ফেনীতে বন্যার্তদের জন্য কমিউনিটি রান্নাঘর চালু করে ২৩ হাজার গরম খাবার দিল কোস্ট ফাউন্ডেশন ইলিয়াছ মিয়া চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বৃক্ষরোপণ পান বাজার রোডে এশিয়া ফার্মেসি উদ্বোধন বৈষম্যমুক্ত কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি ও এম আর পি বাস্তবায়ন চান ওষুধ ব্যবসায়ীরা

কক্সবাজারে রেলওয়ে এবং রোহিঙ্গা কর্মসূচি: দূরে সরিয়ে রাখার রাজনীতি

বার্তা কক্ষ / ১৩৭ বার পড়ছে
আপলোড : বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ পূর্বাহ্ন

রেজাউল করিম চৌধুরী:
শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে লিখতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি, কক্সবাজারের মানুষের স্বার্থে কথা বলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চক্রান্ত হচ্ছে খোদ কক্সবাজারেই! রোহিঙ্গাদের নতুন করে ২০১৭ সালে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়ার পর মানবিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য কক্সবাজারে প্রচুর অর্থের আগমন ঘটছে, এনজিওগুলোর মধ্যে তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গা কর্মসূচির সেই অর্থ বা তহবিল পাওয়ার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা এনজিওদের মধ্যে তৈরি করেছে এক অনাকাক্সিক্ষত অনৈক্য, এর প্রধান কারণ উক্ত তহবিল বিতরণের ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট নীতিমালা ভিত্তিক পদ্ধতির প্রচলন হয়নি এতদিনেও।
কোস্ট ফাউন্ডেশন গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কক্সবাজারের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, কক্সবাজারের উন্নয়নের স্বার্থে কোস্ট সবসময় থেকেছে উচ্চকণ্ঠ। অথচ গুটিকয় স্বার্থান্বেষী মহল কক্সবাজারের বিভিন্ন ফোরামে কক্সবাজারের স্বার্থে কথা বলা থেকে কোস্টকে বিরত রাখার চক্রান্তে লিপ্ত। ২০০১ সাল থেকে কোস্ট কক্সবাজারে শুধু কিছু উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যই কাজ করিনি, কোস্ট বরং কক্সবাজারের নাগরিক সমাজের ঐক্য তৈরি, কুতুবদিয়ার জলবায়ু বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসন, কৃষকের কাছে লবণের ন্যায্যমূল্য পৌঁছে দেওয়া, পাহাড় কাটা বন্ধ করা, মানবিক সহায়তার স্থানীয়করণ, রোহিঙ্গা কর্মসূচির ২৫% অর্থ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যয় করা, প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা, ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার না করে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পানি ব্যবহার করা- ইত্যাতি বিষয়ে সিসিএনএফ, গ্রিন কক্স, বাপাসহ বিভিন্ন নাগরিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর সাথে কাজ করে যােেচ্ছ ।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া আমার জন্মভূমি। ১৯৯৪ সালে ১৪ বছর ধরে পাওয়া শহুরে পরিবেশে নানাবিধ নাগরিক সুবিধা আর মাসিক ৪০ হাজার টাকা বেতন সমৃদ্ধ আন্তর্জাতিক সংস্থার চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমি এবং আমার পরিবার ঢাকা ছেড়ে বসবাস শুরু করি ভোলা দ্বীপের চরফ্যাশন এলাকায়। ঢাকা থেকে চরফ্যাশনে পৌঁছতে ১৮ ঘন্টার লঞ্চ ভ্রমণ এবং পরে গাড়িতে করে আরও ৪ ঘন্টার যাত্রাপথ পাড়ি দিতে হতো তখন। তখন সেখানে বিদ্যুৎ এবং ফোনের সুবিধা ছিল না, তাছাড়া আমার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ১২ হাজার টাকা। কিন্তু আমি সেই ত্যাগটুকু স্বীকার করেছিলাম, কারণ আমি একটি স্বাধীন এবং টেকসই স্থানীয় এনজিও প্রতিষ্ঠা করতে দৃড় সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। এ্যাকশন এইডের একটি প্রকল্পকে একটি স্থানীয় এনজিওতে রূপান্তর করার চ্যালেঞ্জ আমি নিয়েছিলাম। তা করতে গিয়ে, নতুন সংগঠনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দুইবার কর্মী ধর্মঘটের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। এ্যাকশন এইড ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আমাকে সহযোগিতা করে, সে বছরই কোস্ট তার যাত্রা শুরু করে। আমার বিরুদ্ধে ৫৭টি মামলা হয়। ২০০১ সালে আমরা কুতুবদিয়া, মহেশখালী এবং কক্সবাজার সদরে আমাদের কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে কক্সবাজারে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। কক্সবাজারের আমাদের সম্প্রসারণে আমাদেরকে সহযোগিতা করে স্ট্রম ফাউন্ডেশন।
আমি সঠিক বছরটি ভুলে গেছি, হঠাতই আমরা শুনতে পেলাম কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দাদেরকে সরে যেতে হবে। অথচ ১৯৯১ সালের প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপ থেকে এই বাসিন্দারা কক্সবাজার শহর থেকে খানিক দূরের এই জায়গটায় ঠাই নিয়েছিলেন, মরুভূমির মতো বালুকাময় এলাকাটিতে গাছপালা লাগিয়ে সবুজ করে তুলেছিলেন। একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের জমির প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হলো।
স্বাভাবিক কারণেই কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দারা প্রত্যাবসনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তাঁদের এই আন্দোলনে এক পর্যায়ে সংহতি জানায় কোস্ট। এই আন্দোলনে সমর্থন জানানোর কারণে এক পর্যায়ে কক্সবাজারে কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য কোস্টের উপর নিষেধাজ্ঞাও আসে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত যোগাযোগ করে আমরা সেই নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। বেশ কয়েকজন সচিব ও মন্ত্রী আমাদেরকে এই বিষয়ে সহযোগিতা করেছেন।
আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দাদের জন্য মাছ ধরার সুযোগ-সুবিধা আছে এমন কোনও স্থানে বাড়ি নির্মাণ করে প্রত্যাবসনের অনুরোধ জানাই। আমাদের অনুরোধ ছিলো তাঁদেরকে খুরুশকুল এলাকায় পুনর্বাসিত করা। খুরুশকুলের সেই পুনর্বাসন প্রকল্প এখন জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বিশ্বে অন্যতম ব্হৎ পুনর্বাসন প্রকল্প।
আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যটকদের সুবিধার্থে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের আবেদন জানিয়েছিলাম। তিনি কক্সবাজারের একটি জনসভায় আমাদের অনুরোধগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন, সম্ভবত সেই সভাটি এটি ২০১১ বা ২০১৪ সালের এপ্রিলে হয়েছিলো।
উল্লেখ্য যে, প্রায় প্রতি বছরই বাজেটের সময় আমরা/কোস্ট কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইনের জন্য বরাদ্দের দাবিতে ঢাকা এবং কক্সবাজার উভয় স্থানে সেমিনার বা মানববন্ধনের আয়োজন করে আসছি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী থাকাকালীন কক্সবাজারের রেললাইনের জন্য প্রথমে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে তা আবার বাতিল করায় তারও প্রতিবাদও আমরা করেছি।
মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি- বলে একটি কথা আছে। কক্সবাজারে এখন মাসিরা সক্রিয় বেশি, আনুষ্ঠানিকভাবে তারা প্রমাণ করতে চায় যে কোস্ট স্থানীয় নয়, তাঁদের কাছে আমার জন্মস্থান, এবং এই পর্যন্ত কক্সবাজারের জন্য আমরা কী ভূমিকা রেখেছি তা বিবেচ্য নয়! তাঁরা বলতে চাইছেন, যেসব সংস্থার প্রধান কার্যালয় কক্সবাজার, যারা শুধু কক্সবাজারে কাজ করে তারাই কক্সবাজারের স্থানীয় সংস্থা। সেই হিসেবে কোস্টকে তাঁরা স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানতে নারাজ। আমাদের ভোলায় যাওয়া, আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা, দাতাদের উপর কম বা শুণ্য নির্ভরশীলতার পরেও একঝাঁক কর্মী বাহিনী তৈরি করা এবং প্রশংসনীয় পেশাদারিত্ব-এসব কোনও কিছুই তাঁদের কাছে বিবেচনার বিষয় নয়। আমরা স্বাধীনভাবে স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অধিপরামর্শমূলক (এ্যাডভোকেসি) কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। এক্ষেত্রে আমাদের বেশকিছু অর্জনের কথাও আমরা গর্বের সাথে উল্লেখ করতে পারি, যেমন- ইউএনএফসিসিসি কানকুন চুক্তিতে জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি বিষয়টি আমরা অন্তর্ভুক্ত করতে সফল হয়েছি, খুরুশকুল পুনর্বাসন কেন্দ্র, রোহিঙ্গা কর্মসূচিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্থানীয়করণের অন্তর্ভূক্তি ইত্যাদি। বাইরের কারো কাছ থেকে কোনও আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াই সিসিএনএফ-এর মাধ্যমে আমরা কক্সবাজার ও ঢাকায় প্রায় ৩২টি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছি।
মুখে মুখে অনেকেই অধিকার ভিত্তিক এবং স্বনির্ভর নাগরিক সংগঠন প্রয়োজনীয়তা ও তাদের বিকাশের কথা বলেন, কিন্ত বাস্তবে তারা আসলে সেটা চান না। তাঁরা বিভেদ তৈরি করে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, যাতে করে ক্ষমতার হস্তান্তর এবং সকলের অংশগ্রহণ হয় নামেমাত্র।
স্বার্থান্বেষী মহল এটি করছে কারণ কোস্ট রোহিঙ্গা কর্মসূচিতে ভারসাম্যের জন্য এবং কক্সবাজারের শান্তি বজায় রাখার জন্য রাখার জন্য স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক অংশীজনদের মধ্যে সেতুবন্ধনের চেষ্টা করছে। প্রতিবন্ধকতা তৈরির এরকম চক্রান্ত সবসময় পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলে এবং সংঘাত সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত জনগণ ও দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।
কারণ বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই কক্সবাজার শহর/জেলাকে অস্থিতিশীল করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করার কারণে কক্সবাজার ভূ-রাজনীতির একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জেলাটিকে একটি বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর করতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন, একটি গভীর সমুদ্র বন্দর এবং সাবমেরিন কেন্দ্র ইতিমধ্যে নির্মিত হয়ে গেছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আমাদের আচরণের অজুহাতে বিশ্ব মঞ্চে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং আমাদের দেশের ইমেজকে ক্ষুণ্ন করার যেকোনও অপচেষ্টাকেই আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে। স্থানীয় এবং জাতীয় এনজিও, স্থানীয় সরকার, স্থানীয় মিডিয়া এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে সম্ভাব্য সর্বোত্তম অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কাজ করার জন্য আমাদের জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন।

রেজাউল করিম চৌধুরী
নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ফাউন্ডেশন
২৩শে অক্টোবর ২০২৩ ইং।